শিল্প ও সাহিত্য

আমরা হবো আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন আধুনিক মানুষ

শেখ বিবি কাউছার::

আমাদের একটি আধুনিক কারখানা গড়ে তুলতে হবে। কারখানার কথা শুনে অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই। হ্যা,সেই কারখানা হবে মনুষ্যত্ব তৈরির কারখানা যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য নয়। কারণ যন্ত্রপাতি তৈরি করার কারখানার অভাব নেই।কিন্তু মনুষ্যত্ব তৈরির কারখানার আজ বড় অভাব। আমাদের আজ ভালো মানুষ দরকার। আবার ভালো মানুষ গড়তে গিয়ে তারা যেন আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্ব থেকে পিছিয়ে না যায় সেই খেয়ালও রাখতে হবে।

তাহলে এমন মানুষ গড়তে হবে আমাদের যাদের মধ্যে শুধুমাত্র পুঁথিগত শিক্ষাই থাকবে না, থাকবে মনুষ্যত্ববোধ, মানবিকতা,বিশ্বজনীন জ্ঞান ও দক্ষতা,সর্বোপরি গড়তে হবে আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন আধুনিক মানুষ। আমরা সংসার করবো,করবো চাকরি-বাকরি,ব্যবসা-বাণিজ্যও।

কিন্তু এমনভাবে মগ্ন হবো না,যা আমাদেরকে সত্য থেকে বিচ্যুত করে লাভের মোহে ফেলে বিপদগামি করে তোলে। পাওলো কোয়েলহোরের নাম নিশ্চয়ই অনেকে শুনেছেন। তিনি নিঃসন্দেহে একবিংশ শতাব্দীর একজন গুণী লেখক। তাঁর বিখ্যাত ‘আলকেমিস্ট’ বইটিতে আধ্যাত্মিকতার বিষয়ে কিছু বার্তা দিয়েছেন। বর্তমানে আমরা এক কৃত্রিমতার মধ্যে নিজেদের বিলিয়ে দিতে বেশি ভালোবাসছি।

আমরা ভুলে যেতে বসেছি যে আমাদের প্রত্যেকের একটি আধ্যাত্মিক দিক রয়েছে। আমরা,চাইলেই সেখান থেকে দূরে সরে যেতে পারি না। পাওলো কোয়েলহো তাঁর ‘আলকেমিস্ট’ বইটিতে মানুষকে জোরালো ডাক দেয় অধ্যাত্ম বস্তুজীবনের অপরিহার্য সহচর করে নিতে।

অধ্যাত্ম কিঃ নিজেকে জানার নামই অধ্যাত্ম। অর্থাৎ আত্মা সম্পর্কিত জ্ঞান। আমি কে? কোথা থেকে এসেছি? কোথায় যাবো? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর অনেক রকম হতে পারে। যেমন দরুণ আমি অমুকের মেয়ে,অমুক জায়গা থেকে এসেছি, অমুক জায়গায় যাব ইত্যাদি। কিন্তু প্রকৃত জানা হলো আমি পরম স্রষ্টারই সৃষ্টি এবং তার মূল সত্তা- যার নাম আত্মা।

সুতরাং অধ্যাত্মবাদ হলো মানুষের নিজের ভেতরই যে আত্মারূপে পরমাত্মা বাস করে তাকে জানার তত্ত্ব।

মহামতি সক্রেটিস, যিশুখ্রিষ্টের জন্মের আগে,প্রথমে ‘নিজেকে জানো’ বা ‘ know thyself ’ এই তত্ত্বটি প্রচার করেন।

লোকজন তাঁকে যদি জ্ঞানী বলতেন,তিনি বলতেন, “তোমরা আমাকে জ্ঞানী বলো না,কারণ আমি জ্ঞানী নই,আমি জ্ঞান অনুরাগী।” বিশিষ্ট সুফি লেখক মোহাম্মদ আবুল খায়ের তাঁর ‘সুফিসাধনা’ বইয়ে উল্লেখ করেন যে, ‘পাশ্চাত্যে আধ্যাত্মিক শিক্ষাকে তারা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। কারণ তারা গবেষণা করে দেখেছে,মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় এবং নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে আধ্যাত্মিক শিক্ষা বেশ ফলদায়ক। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা আরো তিন দশকেরও আগে আধ্যাত্মিক শিক্ষাকে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে গ্রহণ করেছে।তাই পাশ্চাত্যে এখন সুফিবাদের ধারাটিও দ্রুত বিকাশ লাভ করছে।

তাই এটি হৃদয় থেকে হৃদয় হয়ে খানিকটা বিস্তৃত হয়ে উঠুক আমাদের বই পুস্তকে,একাডেমিক পর্যায়ে।’ আমরা সবাই চেষ্টা করি ভালো মানুষ হতে, ভালো মানুষ গড়তে। আর ভালো মানুষ হতে কে না চাই? প্রতিটি মানুষের মনে দুটি দিক রয়েছে। একটি তার ইতিবাচক দিক আর অন্যটি হলো নেতিবাচক দিক।মানব মনের এই নেতিবাচক দিক গুলোকে নিয়ন্ত্রণ বা বর্জন করে মানবীয় গুণাবলির মাধ্যমে সত্যিকার ইতিবাচক দিকটিকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব আধ্যাত্মিকতার শিক্ষার মাধ্যমে।

আমরা অধিকাংশ সময় নিজের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে অন্যের কাজকর্ম বা আচার-আচরণকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করি। কিন্তু নিজের বেলায় তা করি না। করি না কারণ আমরা প্রত্যেককে মনে করি আমরা অন্যের চেয়ে বেশি জানি বা আমিই শুদ্ধ। মূ

লত আমাদের মনের ভেতর যেটি কাজ করে তাহলো ‘আমিত্ব’। ‘আমিত্ব’ বলতে বোঝায় আমার নিজের সত্তা। ভাবার্থে বোঝায় আমার অহংকার, দাম্ভিকতা। এই আমিত্বই মানুষকে অনেক পেছনে ফেলে দেয়। কারণ আমিত্বের মাঝে থাকার অর্থই হলো শয়তানের সঙ্গে থাকা। সে বিষয়টাই আমরা অনেক সময় বুঝি না।

পবিত্র কোরআন এ অসংখ্য বার আল্লাহ বলেছেন অহংকার করো না। তিনি অহংকারীকে ভালোবাসেন না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা যেমন অনেক অভাবনীয় জিনিস পেয়েছি ঠিক তেমনি কিছু জিনিসও হারিয়ে ফেলছি।

যেমনঃনৈতিকতা,মানবিকতা,সততা,মূল্যবোধ,আত্মিউন্নয়ন, মানুষের শুদ্ধতা,সৃষ্টির প্রতি কল্যাণ ইত্যাদি। এই গুলোর জন্য প্রয়োজন সুফি ভাবাদর্শ বা আধ্যাত্মিক দর্শন। সমাজের সকলের পক্ষে সুফি হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু জীবনবোধের মূলে সুফি বা আধ্যাত্মিক আর্দশ থাকতে হবে। নইলে মানবিক চেতনাসম্পন্ন সমাজ গড়ে উঠবে না। একটু ভেবে দেখুন, বর্তমান প্রযুক্তি নির্ভর যুগে এসে নিজেকে এবং নিজের আত্মাকে কলুষমুক্ত রাখা অত্যন্ত কঠিন এবং বর্তমানে একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠছে অত্যন্ত উশৃংখল ও খামখেয়ালিভাবে। এই একুশ শতকে আমাদের হতে হবে উদার ও বিজ্ঞান মনস্ক। এই কথাটা প্রকৃত সত্য যে,তলোয়ার নিয়ে প্রেমের আহবান জানানো যায় না, বলা যায় না শান্তির কথা।

প্রেমের আহবান হয় প্রেমের বাণী দিয়ে, কবিতা দিয়ে, সংগীত দিয়ে, ফুল দিয়ে, ভালবাসা, বিশ্বাস, সান্তনা ও ভরসা দিয়ে।

মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি ( রাঃ) বলেছেন, “ বজ্রপাতে ফুল ফোটে না,ফুল ফোটে বৃষ্টিতে।” মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি বলেছেন, “ যদি তুমি কখনও আধ্যাত্মিক জগতের কোন জ্ঞানীর সাক্ষাৎ পাও, তাহলে তাঁর সাথে নম্র ও বিনয়ীভাবে কথা বল এবং তাঁর কাছ থেকে কিছু শেখার জন্য আগ্রহী হও।’’

আসুন আমরা অভিভাবক ও শিক্ষকরা প্রথমে নিজেরাই আধ্যাত্মিকতার আলোয় আলোকিত হয়ে আমাদের সন্তান ও শিক্ষার্থীদের মাঝে সেই আলো ছড়িয়ে দিই। তাহলেই আগামী দিনে আমরা পাবো একটি সুস্থ, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন সমাজ তথা রাষ্ট্র।
(রিপোস্ট)

লেখক, শেখ বিবি কাউছার, প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, নোয়াপাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, রাউজান, চট্টগ্রাম

Please follow and like us:

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button