শিল্প ও সাহিত্য

এক ঐশ্বরিক ও মানবিক হৃদয়ের অধিকারী ড. জামাল নজরুল ইসলাম

বুক রিভিউ, বইয়ের নাম: ড. জামাল নজরুল ইসলাম: লেখক: বিদ্যুৎ কুমার দাশ প্রকাশনী : খড়িমাটি, পৃষ্ঠা : ৫৬, বইয়ের ধরন : সাক্ষাৎকারমূলক

শেখ বিবি কাউছার:: অনেক দিন থেকেই উনার সম্পর্কে ভালোভাবে জানার জন্য বইয়ের খোঁজ করছিলাম। অবশেষে সেদিন বাতিঘরের বইটি চোখে পড়ার সাথে সাথে নিয়ে ফেললাম। ভেতরে লেখা কি আছে দেখিনি। শুধু মলাটে উনার ছবিটা দেখি। বইটি আমাদের কলেজ লাইব্রেরির জন্য সংগ্রহ করে নিলাম। যেন শিক্ষার্থীরা উনার সম্পর্কে জানতে পারে। আমাদের একটা স্বভাব হলো যা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাতে আসে না তা আমরা পড়িই না। যার কারণে জানার আগ্রহ জন্মই না পড়ার। এত বড় মাপের একজন বিজ্ঞানী আছেন অথচ উনার উপর কোন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাতে প্রশ্ন কেউ দেখেছেন কি না জানি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা বলেন আর বিসিএস পরীক্ষাই বলেন যদি প্রশ্ন আসতো নিশ্চয়ই শিক্ষার্থীরা অনন্ত পড়তো। জানার আগ্রহ থাকতো।

৫৬ পৃষ্ঠার ছোট্ট বইটি আজ( ১৬ মার্চ) কলেজ লাইব্রেরিতে বসে পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম, নিজ দেশের গুণীজনদের সম্পর্কে কতই না কম জানি!
বইটি মূলত ড. জামাল নজরুল ইসলামের সাক্ষাৎকার নিয়ে লেখা হয়েছে, লিখেছেন বিদ্যুৎ কুমার দাশ। যিনি এই মানুষটিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। লেখকের সাথে বিজ্ঞানীর ছিল পিতা-পুত্রের সম্পর্ক। ছিল গভীর সান্নিধ্য।

বইয়ের কিছু কথা পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।

লেখক : আমাদের দেশে জীবিত অবস্থায় আলোকিত গুণিদের মূল্যায়ন খুবই কম হয়। অথচ জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের মেধায় মুগ্ধ হয়ে এক বৃটিশ দম্পতি তাঁদের সন্তানের নাম রেখেছিলেন – ‘জামাল’।

লেখক আরও উল্লেখ করেন,
“ উপমহাদেশে আমি সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আমলা, সাংবাদিকসহ অগণিত প্রথম সারির ব্যক্তিদের সাথে মিশেছেন। কিন্তু মহৎ ধ্যানী, জ্ঞানী,ঋষি, বিজ্ঞানী মহামানবের সারির মধ্যে প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলামের সমমাপের ও মনের ব্যক্তিত্ব আমি আর একজন পেয়েছি কিনা সন্দেহ। বেশির ভাগ মানুষের কোন না কোন চালাকি আছে! তাঁরা শিক্ষাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন। মানুষকে ধোঁকা দেয়, করে সর্বশান্ত। আর টাকার পাহাড় করার পরিকল্পনায় মত্ত। কিন্তু ড. জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের মধ্যে এসব আচরণ তাঁর শরীরে ও মনে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেনি। সেজন্য তিনি একজন বিজ্ঞানী নন, তিনি একজন ঋষি, ধ্যানী,জ্ঞানী। বইটিতে লেখক ভিন্ন রকমের ব্যক্তিসত্তা উপস্থাপন করেছেন।

জামাল নজরুল ইসলাম এর উক্তি : বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে, সত্যেন বোস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য ছিলেন। প্রফেসর আবদুস সালাম ( নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত) উনি বলেছেন বাংলাদেশে বিজ্ঞান চর্চার আগ্রহ যেভাবে দেখি আর অন্য কোন দেশে দেখি না।
সাহিত্য ও বিজ্ঞান এর মধ্যে সম্পর্ক আছে কি এর উত্তর এ তিনি বলেছেন,
“ সাহিত্য ও বিজ্ঞান, ধর্ম সঙ্গীত এদের কোনভাবে পরস্পর বিরোধিতা নেই। বরঞ্চ এগুলো সুন্দরভাবে পরস্পরের সসম্পূরক ভূমিকা রাখে। ”

★ সাহিত্য -সঙ্গীত -দর্শন সবদিকেই তাঁর ছিল মনোযোগ। অসাধারণ আবৃত্তি করতেন,রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন দরাজ গলায়। এত গুণ একটা মানুষের মধ্যে!

তিনি তরুণ কবিদের নিয়েও মতামত প্রদান করেছেন। বলেন, “ তরুণ কবিদের মধ্যে প্রচুর সম্ভাবনা দেখি। তাঁদের লেখা মনোযোগের দাবি রাখে।এদের মধ্যে সমাজের চিন্তা অনুভূতি সৃজনশীলতা রয়েছে, সেগুলো বিরাট সম্ভাবনা দেখি।”

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ মূলধারার শিক্ষার প্রধান উপকরণ হওয়া উচিত বাংলা, তবে বাংলা স্কুলে ইংরেজির মান ভালো করতে হবে। সীমিত পরিমাণে ইংরেজি মাধ্যমে স্কুল থাকতে পারে,যারা বিদেশে কাজ করবেন-এমন শিক্ষার্থীদের জন্য। এ দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সকল জ্ঞানী-গুণীকে দেখেছি, তাঁদের প্রায় সবাই বাংলা মাধ্যম থেকে এসেছেন। দেশের প্রশাসন থেকে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতে হলে তো বাংলা মাধ্যমই জরুরি। ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেদের বাংলায় দুর্বলতা থাকে। আরেকটা কথা, এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ বিশ্বমানের বলে মনে করি আমি। এমন কিছু ছেলে পিএইচডি করছেন, যা পৃথিবীর যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সঙ্গে তুলনীয়। এই ছাত্ররাও বাংলা মাধ্যমের। যাদের দরকার, তারা ইংরেজি অবশ্যই শিখে নেবে এটাই হওয়া উচিত স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
ড. জামাল নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম এর কথা যে বলে গেছেন লেখক তা সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন বইটিতে।

কিছু জানা ও অজানা কথা:
★ ড. অনুপম সেন, ড. জামাল নজরুল ইসলামকে নিয়ে লেখা “ খ্যাতির ডানায় আরো অনেকদিন” প্রবন্ধের শেষে লিখেছেন – “ তাঁর মতো মহান সরল মানুষ সত্যিই দুর্লভ।”

★ “দি আলটিমেটি ফেইট অব দি ইউনিভার্স” বা “মহা বিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি” নামের বইটি পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি প্রধান ভাষার অনূদিত হয়েছে।

★ ক্যাম্ব্রিজ থেকেই মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি পি এইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবার ‘ ডক্টর অব সায়েন্স’ ডিগ্রি পেয়েছেন। বাংলাদেশ এ এত বড় বিজ্ঞানী আর জন্মাবে কিনা সন্দেহ।

★ আমাদের বিশ্ববিখ্যাত এই বিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধানে -৪৫ জন গবেষক এমফিল ও পিএইচডি করেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ মাত্র ৮টি। অপ্রকাশিত গ্রন্থ এর সংখ্যা -৪৪ টি। বিষয়টি অবাক করার মত।

★ স্টিফেন হকিং বলেছেন, “ জামাল নজরুল ইসলাম এর কাছে আমি কিছুই না। হকিংয়ের এর চেয়ে বড় বিজ্ঞানী ছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম। তিনি স্টিফেন হকিংয়ের রুমমেট ছিলেন।

★ উনার বাবা খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলাম দেশ বিভাগের সময় অবিভক্ত বাংলার ভারপ্রাপ্ত সচিব ছিলেন। মা রাহাত আরা বেগম উর্দু কবি ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এর ‘ ডাকঘর ‘ উর্দুতে অনুবাদ করেছিলেন।

★ বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জামাল স্যারের ফুফাতো ভাই।

★ কাজী নজরুল ইসলাম উনাদের কোলকাতা বাড়িতে যেতেন।
এই মহান মানুষটি ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। আর ১৬ মার্চ ২০১৩ সালে ইন্তেকাল করেন।
বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে যাঁরা পড়াশোনা করেন তাঁরা বইটি পড়ে দেখবেন আশাকরি।

শেখ বিবি কাউছার
প্রভাষক ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ রাউজান চট্টগ্রাম

Please follow and like us:

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button