শিল্প ও সাহিত্য

কয় জন ভালো নয়, সয় জন ভালো হয়

ফজলুর রহমান::
টমাস আলভা এডিসন এর এক শিক্ষক বলেছিলেন, ‘সে এমন এক অপদার্থ যে, কোনকিছু শেখা অন্তত তার দ্বারা সম্ভব নয়।’  সেই এডিসনই হয়ে গেলেন গ্রামোফোন, ভিডিও ক্যামেরা এবং বৈদ্যুতিক বাতিসহ বহু যন্ত্রের উদ্ভাবক! আলবার্ট আইনস্টাইন চার বছর বয়স পর্যন্ত কথাই বলতে পারতেন না। কাছের লোকজন থেকে শিক্ষক- সবাই বলেছিলেন, ‘ও জীবনে কিছুই করতে পারবে না।’ সেই তিনিই হয়ে গেলেন বিজ্ঞানের গতিপথ বদলে দেয়ার নায়ক। আব্রাহাম লিঙ্কন জন্মেছিলেন অতি দরিদ্র ঘরে। দেখতেও সুশ্রী ছিলেন না। ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে মূলধন হারান। কিছুদিন বাদে যার সাথে বিয়ে হবে, হঠাৎ তারও মৃত্যু হয়। নার্ভাস ব্রেকডাউন রোগও ছিল তাঁর। তিনি ৮ বার নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন। প্রথম জীবনে সকলে তাঁকে ব্যর্থ হিসেবেই চিহ্নিত করতেন। সেই তিনিই একদিন হয়ে গেলেন আমেরিকার ১৬তম রাষ্ট্রপতি এবং বিশ্ব ইতিহাসে অমর রাষ্ট্রনায়কদের একজন।

এভাবে যাঁরা সফল হয়ে উঠেন, তাঁদের অনেকের সফলতার গল্পের পেছনেই ব্যর্থতার গল্প রয়েছে। কিন্তু কেউ কখনো তখন বলেননি, ‘আমি পারবো।” তাঁদের কাজই তাঁদের হয়ে কথা বলে যাচ্ছে। জীবনে কখনো হোঁচটই যদি না খেলেন তবে উঠে দাঁড়াবেন কি করে? ব্যর্থতা আছে বলেই সাফল্যের স্বাদ এত মিষ্টি। দুঃখের ভার আছে বলেই আনন্দ এতো হালকা লাগে। তাই সব সময় লক্ষ্যে অবিচল থাকতে পারাটা ভালো। আপাত ব্যর্থতা যে কোন মূহুর্তে আপনার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। এজন্য বলা হয়ে থাকে- “কয় জন ভালো নয়,সয় জন ভালো হয়।”

 

আসলে সাফল্যের জন্য প্রয়োজন ধৈর্য বা অপেক্ষা। তবে, এ অপেক্ষা মানে অসহায়ের মতো বসে থাকা নয়, এ অপেক্ষা ক্রমাগত প্রচেষ্টার, নীরবে একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণের। অবিচল বিশ্বাসে নিরলস পরিশ্রম করার নামই ধৈর্য। এই ধৈর্য প্রতিটি ব্যর্থতাকে সাফল্যের বীজে পরিণত করে, প্রতিকূলতাকে অনুকূলে, সমস্যাকে সম্ভাবনায় রূপান্তরিত করে। ধৈর্য হচ্ছে যেকোন পরিস্থিতিকে হজম করার ক্ষমতা। ধৈর্য এমন এক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকৗশল যা সব প্রতিকূলতাকে ক্রমান্বয়ে নিস্ক্রিয় করে দেয়।

 

ধৈর্য একটি অসাধারণ মানসিক শক্তি। অন্য সব শক্তির মত, এই শক্তিকেও অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জন করা যায়।  এই অনুশীলন তো আমাদের সহজাত বৈশিষ্ট্য। জন্মের পর থেকেই ধীরে ধীরে লক্ষ্য এগিয়ে চলার শিক্ষা পাই আমরা। এই যেমন  শিশু জন্মের পর শুধু হাত-পা নাড়ে। এরপর সোজা হয়ে শুয়ে থাকে কেবল। এক সময় সে কাত হতে শেখে। পরে উপুড় হতে পারে। তারপর শুরু হয় হামাগুড়ি। পরে হাতে-পায়ে হাঁটা। এরপর সে উঠে দাঁড়ায়, হাঁটি হাঁটি পা পা করে। হাঁটতে গিয়ে সে বারবার পড়ে। আবার উঠে দাঁড়ায়, আবার হাঁটতে শুরু করে। এক সময় কারো সাহায্য ছাড়াই সে হাঁটে, দৌড়ায়। শিশুর এই সফলতা আসেবেই- এমন ভরসা নিয়েই সকলে অপেক্ষা করেন মাসের পর মাস। আমাদের মাঝেও যদি ধৈর্য থাকে, তবে নিজের প্রতি নিজের যেমন দৃঢ় বিশ্বাস থাকবে, তেমনি অন্যরাও আপনার ওপর ভরসা করতে পারবে।

 

এজন্য মহামতিরা সবসময় ধৈর্যগুণের কথা বারবার বলেছেন। দার্শনিক ও কবি রালফ ইমারসন বলেন, “প্রকৃতির গোপন শক্তিটিকে অর্জন করার চেষ্টা করো। গোপন শক্তিটি হলো, ধৈর্য।” ব্রাজিলিয়ান লেখক পাওলো কোয়েলহো বলেছেন “আমার জীবনে আমি অনেক ঝড় দেখেছি। আর আমি শিখেছি ঝড়কে নিয়ন্ত্রণের শক্তি আমার নেই। কিন্তু আমার আছে ধৈর্য, যার মাধ্যমে আমি ঝড়ের সময় পার করে আগামীর দিকে তাকাতে পারি।” সাহিত্যিক লিও টলস্টয় বলেছেন, “ধৈর্য হলো জগতের সবচেয়ে শক্তিমান যোদ্ধা।” আর দার্শনিক ও সূফী জালালউদ্দিন রুমী বরাবরের মতোই দরদ মাখিয়ে বলেছেন, “অন্ধকার হলে ধৈর্য ধরে বসে থাকো; ভোর আসছে। সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ সেবকরা কখনও ধৈর্য হারায় না, কারণ তারা জানে নতুন চাঁদের পূর্ণিমা পর্যন্ত যেতে সময় লাগে।”

 

এজন্য কথায় বলে, সবুরে মেওয়া ফলে। ধৈর্য ধরা একটু কঠিন হলেও, অবশেষে লাভ কিন্তু ধৈর্যশীলদেরই হয়। তো কিভাবে এই ধৈর্যশক্তি আসবে? ধৈর্য বাড়ানোর কিছু কৌশল জানিয়েছে জীবনধারা বিষয়ক ওয়েবসাইট ইনংডটকম।

১. অপেক্ষা করতে শিখুন।
ধৈর্য শেখার সবচেয়ে বড় উপায় হলো, অপেক্ষা করতে শেখা। সাইকোলজি সায়েন্সের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন মতে, অপেক্ষা দীর্ঘমেয়াদিভাবে মানুষকে সুখী করে। ধরুন, কারো ফোন করার কথা, এখনো করছে না, হন্তদন্ত হয়ে তাকে ফোন না দিয়ে একটু অপেক্ষা করুন তার ফোন আসার।
২. গুরুত্বপূর্ণ কাজ করুন।
মানসিক চাপ থেকে কিন্তু ধর্যৈচ্যুতি ঘটে। তাই মানসিক চাপ বা কাজের চাপগুলো ব্যবস্থাপনা জরুরি। চাপ কমানোর একটি উপায় হলো অপ্রয়োজনীয় কাজগুলো না করা। এমন কিছু বিষয়ের তালিকা করুন যেগুলো আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। অপ্রয়োজনীয় কাজগুলো করে মানসিক চাপ তৈরি না করে জরুরি কাজগুলো আগে শেষ করুন।
৩. কোন বিষয়ে অধৈর্য হচ্ছেন তা লিখে ফেলুন।
যেসব বিষয় আপনাকে অধৈর্য করে তোলে সেগুলো সম্পর্কে একটু ভাবুন। প্রয়োজনে আপনার অস্থিরতার অনুভূতিগুলো খাতায় লিখে ফেলুন। এটি আপনাকে সেসব বিষয়ে ফোকাস করতে সাহায্য করবে। ভাবুন, অধৈর্য হয়ে কী পাচ্ছেন আপনি,  উল্টো হয়তো ছোট হচ্ছেন অন্যের কাছে। তাই চেষ্টা করুন এ সময়টায় শিথিল থাকার।
৪. শিথিল থাকুন এবং গভীর শ্বাস নিন।
খুব অধৈর্য লাগলে শিথিল থাকার চেষ্টা করুন। আর এ ক্ষেত্রে গভীরভাবে শ্বাস নিতে পারেন। এটি ওই সময়ের জন্য আপনাকে শান্ত করতে সাহায্য করবে।
এই ক্ষেত্রে নাক দিয়ে গভীরভাবে শ্বাস নিন। কিছুক্ষণ দম আটকে রাখুন। এবার মুখে দিয়ে দম বের করুন। আবার নাক দিয়ে শ্বাস নিন। কয়েকবার এই পদ্ধতি অনুসরণ করুন। এ পদ্ধতি আপনাকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে।
এএআরপি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়, ‘কম কথা বলার বিষয়টি মস্তিষ্কের জন্য ভালো। এতে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা সঠিক থাকে এবং কোনো কথা বলার আগে চিন্তা করে নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়’। যারা বেশি চুপচাপ থাকেন তাদের মস্তিষ্ক অনেক দ্রুত কাজ করে এবং তারা নিজেকে শান্ত রেখে অনেক কিছু নিয়ে চিন্তা করে, এরপর কোনো একটি ব্যাপারে নিজেদের মত প্রকাশ করে থাকেন। আর চিন্তা করে কথা বলার বিষয়টিই বুদ্ধিমান মানুষের পরিচায়ক।
বলা হয়ে থাকে, হতাশা বিজয়ের মূল শত্রু। তাই ধৈর্য্য এবং বুদ্ধির সাথে সাফল্যের অপেক্ষা করতে হবে।
আমরা শিব খেরার সেই কথাটি মনে রাখতে পারি, ‘‘বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা আলাদা কাজ করে না, তারা একই কাজ ভিন্ন ভাবে করে।”
আর মেনে চলতে পারি কবিতা সন্ন্যাসী আবুল হাসান এর কবিতার লাইনগুলো,
“ঝিনুক নীরবে সহো/
ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও/
ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুঁজে মুক্তা ফলাও।”

 

লেখক: ফজলুর রহমান, রচনা সাহিত্যিক এবং উপ-পরিচালক (জনসংযোগ), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।

Please follow and like us:

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button