মতামত

অ্যান্থ্রোপোসিন যুগে দাঁড়িয়ে জলবায়ু ভাবনা

ফজলুর রহমান:: শুরুতে একটি সতর্কবাণী পড়ি। যা সম্প্রতি বলেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেছেন, ‘‘গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বাড়ছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা ক্রমাগতও বাড়ছে এবং আমাদের গ্রহ দ্রুত এমন একটি জায়গায় পৌঁছাবে যে জলবায়ু সৃষ্ট বিশৃঙ্খলাকে আর বিপরীত দিকে আনা যাবে সম্ভব হবে না। আমরা এখন জলবায়ু নরকের হাইওয়েতে আছি এবং আমাদের পা গাড়ির গতিবর্ধকে।”

পর্তুগালের ইউনিভার্সটি অফ পোর্তার একটি গবেষণা বলেছিল, মানুষের কার্যকলাপের জন্য প্রকৃতি ক্রমেই তুমুল বিশৃঙ্খলতার দিকে এগুচ্ছে। যত সময় এগোবে তত প্রকট হবে সেই বিশৃঙ্খলা। এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতিবিদ্য বিভাগের অধ্যাপক ড. অরফিউ বাতোর্লমি এর মতে, “পরিবেশের উপর মানুষের যথেচ্ছাচার যদি এইভাবে চলতে থাকে তাহলে এক সময়ে এসে প্রকৃতি অনিশ্চিত রূপ ধারণ করবে, গণিতের ভাষায় যাকে বলা হয় বিশৃঙ্খল আচরণ (Chaotic behavior)।” উক্ত টিমের গবেষকদের আশংকা এই যে, এমন একটা সময় আসবে যখন মানুষ আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচার শক্তিটাই হারিয়ে ফেলবে। আর বিপর্যয় এর সামনে শক্তি হারিয়ে ফেলা মানেই তো নিজের অসহায় আত্নসমর্পন।
<span;>আর এই বিশৃঙ্খলা বাড়ার লক্ষণ আমাদের সামনে এরইমধ্যে দৃশ্যমান। এই বিশৃঙ্খলা বাড়ার সাথে সাথে আরো বাড়ছে প্রাকৃতিক দুযোগ, যেমন- অসহনীয় তাপমাত্রা, আগ্রাসী ঝড়, মারাত্নক খরা, ভয়ংকর বন্যা।

এই বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী কে? আমরাই তো! -মানুষ। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে মানুষ পৃথিবীর ইকোসিস্টেম এতটাই বদলে চলেছে যে, বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই সময়কালকে ‘অ্যান্থ্রোপোসিন’ বা মানুষের যুগ বলা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা নতুন ‘ভূতাত্ত্বিক যুগ’ ‘দ্য অ্যান্থ্রোপোসিন’ ঘোষণা দিতে চাচ্ছেন। অ্যান্থ্রোপলিসিন এর অ্যান্থ্রো অর্থ হলো মানুষ বা মানুষ সম্বন্ধীয়। পলিসিন বলতে বর্তমান ভৌগলিক সময়কালকে বুঝায়, যখন পরিবেশ প্রকৃতি মূলত মানুষের কার্যকলাপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। পৃথিবীর প্রাকৃতিক সিস্টেমের ওপর মানুষের প্রভাব এতই বেশি যে, বর্তমানে প্রকৃতির চরিত্র ও তার ভবিষ্যত মানুষই নিয়ন্ত্রণ করছে।

গবেষণায় বলা হচ্ছে, সৃষ্টিজগতের ০.০১ ভাগ হয়েও বাকি সব প্রাণ বিনাশ করছে মানুষ। হোমো স্যাপিয়েন্স আখ্যা দিয়ে মানবজাতিকে আধিপত্যের জায়গা দেওয়া হলেও আমরা আসলে মোট ওজনের তুলনায় খুবই ক্ষুদ্র। পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা ভাইরাসের মোট ওজন সব মানুষের চাইতে তিনগুণ বেশি। কীটদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। মাছেরা আমাদের চাইতে ১২ গুণ বেশি আর ফাঙ্গাস প্রায় দুইশ গুণ বড়। পৃথিবীতে জীবজগতের সব ধরণের প্রাণির সংখ্যা ও অন্যান্য প্রাণির উপর মানবজাতির প্রভাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পিএনএস বা প্রোসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসের করা সমীক্ষা বলছে, পুরো সৃষ্টিজগতে মানুষ সংখ্যায় অত্যন্ত কম। কিন্তু প্রকৃতি ও বাকি সমস্ত প্রাণের উপর তাদের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি, আর তা খুবই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সমীক্ষা অনুযায়ী পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ৭.৬ বিলিয়ন হলেও তা সমস্ত প্রাণিজগতের ০.০১ শতাংশ মাত্র। কিন্তু সভ্যতার শুরু থেকে এই মানুষই ৮৩% বন্য স্তন্যপায়ী প্রাণি ও আর অর্ধেক গাছপালা শেষ করে ফেলেছে।  অথচ এসব গাছপালা আর পশুপাখির উপর নির্ভর করেই মানুষ বেঁচে আছে। মানুষ যখন থেকে কৃষিকাজ শুরু করেছে অথবা শিল্পোন্নয়নের ফলে যে বিরাট আকারের ক্ষতি হয়েছে তা উঠে এসেছে প্রাণিজগৎ নিয়ে করা এই সমীক্ষায়। সমীক্ষাটি চালাতে গবেষকরা শত শত পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করেছেন। স্যাটেলাইট রিমোটের দ্বারা বিশাল জায়গা স্ক্যান করা, আণুবীক্ষণিক জগতের জিনগত বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণের মত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরীক্ষাগুলো চালানো হয়েছে।

জামার্ন ভূতত্ত্ববিদ হিসেবে রাইনহল্ড লাইনফেল্ডার এ বিষয়ে বলেন, ‘‘এক বড় আকারের গবেষণার আওতায় আমরা মানুষের এতকাল ব্যবহার করা জ্বালানির পরিমাণ মাপার চেষ্টা করেছিলাম। ভূতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী মানুষ গত ৭০ বছরে পৃথিবীর উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছে। তার আগের ১২,০০০ বছরের তুলনায় মানুষ এই সময়কালে দেড় গুণ বেশি জ্বালানি ব্যবহার করেছে। ফলে জ্বালানি ব্যবহারের গতিবৃদ্ধি স্পষ্ট হয়ে উঠছে।” বর্তমানে মানুষের বাৎসরিক জ্বালানির চাহিদা প্রায় ১৭০ ট্রিলিয়ন কিলোওয়াট আওয়ার! জনসংখ্যাও বেড়ে চলেছে। বর্তমানে ৮০০ কোটি হলেও ২০৫০ সালের মধ্যে মানুষের সংখ্যা বেড়ে ১,০০০ কোটি হয়ে দাঁড়াবে।

আমাদের কাছে একটি মাত্র পৃথিবী। গোটা বিশ্বে এখনো পর্যন্ত একটিমাত্র গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেখানে উন্নত জীবের বিকাশ আছে। জ্বালানির ক্ষুধা মেটাতে মানুষ গোটা গ্রহ শোষণ করে চলেছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে জীবজগতের সব বাসভূমি ধ্বংস হবার উপক্রম দেখা যাচ্ছে। জামার্নির ফ্রাংকফুর্টের সেনকেনব্যার্গ মিউজিয়ামের ফল্কার মোসব্রুগার-এর মতে, “আমরা প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু প্রতি বছর প্রকৃতি থেকে আমাদের চাহিদা নতুন করে প্রকৃতির পুনরুজ্জীবনের হারের তুলনায় অনেক বেশি। অর্থাৎ আমাদের বেঁচে থাকার মূলধনই আমরা খেয়ে ফেলছি অথবা ব্যবহার করছি। ধরুন, এই আপেলটি আমাদের পৃথিবী, যার ব্যাস ১২ থেকে ১৩ হাজার কিলোমিটার। হিসেব করে দেখলে বুঝবেন, সামান্য কয়েক ডেসিমিটার বা মিটার এই আপেলের চিকন খোসার মতো। সেই স্তর ব্যবহার করে আমরা ৮০০ কোটি মানুষের জন্য আজ শক্তি টেনে নিচ্চ্ছি।”

‘অ্যান্থ্রোপোসিন’ যুগে তাহলে কি কোন আশা নেই? তা অবশ্যই আছে। এরইমধ্যে অনেক দেশ ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ‘নেট জিরো’ পর্যায়ে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এর মানে হল, তারা গ্রিন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ যতটা সম্ভব কমিয়ে আনবে এবং বাকিটার ভারসাম্য আনবে সমপরিমাণ কার্বন বায়ুমন্ডল থেকে শুষে নেওয়ার ব্যবস্থা করে।

দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বা কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর পরও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের ৩৩টি দেশ ভালো পরিমাণ জিডিপি অর্জন করেছে। উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের বদলে সবুজ শক্তি ব্যবহার করে বেশ ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। ইকোনমিস্ট জানিয়েছে, ১৫ বছর পর যুক্তরাষ্ট্র কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার ১৩০ কোটি টন কমিয়ে এনেছে। দেশটির বেসামরিক নাগরিকদের বাসা-বাড়ি ও প্রতিষ্ঠান থেকে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ১৫ শতাংশ কমার ফলেই সামগ্রিক নিসঃরণের পরিমাণ কমেছে। মূলত দুইটি বড় পরিবর্তনের ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বা উৎপাদনের সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির সম্পর্ক কমছে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির অবকাঠামোগত পরিবর্তন ঘটছে। দ্বিতীয়ত, উন্নত দেশগুলো এখন পরিবেশবান্ধব/ নবায়নযোগ্য শক্তি আমদানিতে গুরুত্ব দিচ্ছে।

নবায়নযোগ্য শক্তি কি নবায়নযোগ্য শক্তি বা রিনিউয়েবল এনার্জি হলো এমন শক্তির উৎস, যা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পুনরায় ব্যবহার করা যায় এবং এর ফলে শক্তির উৎসটি নিঃশেষ হয়ে যায় না। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস যেমন- সূর্যের আলো ও তাপ, বায়ু প্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈব শক্তি (জৈবভর), ভূ-তাপ, সমুদ্র তরঙ্গ, সমুদ্র-তাপ, জোয়ার-ভাটা, শহুরে আর্বর্জনা, হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল ইত্যাদি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। পৃথিবীতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। আশা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ মানুষের বিদ্যুতের চাহিদার ৮৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি বা রিনিউয়েবল এনার্জি থেকে পূরণ করা হবে।

বিপদ কমাতে ব্যক্তি কী করতে পারে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, ব্যক্তি পর্যায়ে ছোটখাটো অভ্যাসের পরিবর্তনের মাধ্যমেও কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সামষ্টিকভাবে বড় ভূমিকা রাখা সম্ভব। উড়োজাহাজে চড়া কমিয়ে দেওয়া যায়।

গাড়ি ব্যবহার কমিয়ে দেয়া যায়। বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহার করা যায়। মাংস এবং ডেইরি পণ্য খাওয়া কমিয়ে দেয়া যায়। দৈনিক জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে এনে ঘরের কাজে জ্বালানি সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়িয়ে দেয়া যায়।

শীতের দেশে ঘর গরম করার কাজে গ্যাসনির্ভর হিটারের বদলে ইলেক্ট্রিক হিট পাম্প ব্যবহার করা যায়। পরিবেশ বান্ধব/ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তোলা যায়।

জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর কেবলই পরিবেশগত নয়। এর ব্যাপ্তি ক্রমেই ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর। এর সাথে বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন জড়িত। এটি অবধারিত এক বৈশ্বিক ঘটনা – যা অর্থনীতি, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, জীবনযাপন, খাবারের যোগান, এমনকি রাজনীতি পর্যন্ত প্রভাবিত করছে। আমাদের জীবনযাপনে নানা দিকে এই প্রভাব দেখতে পাচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দৃশ্যপটকে মোকাবেলায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে আরো দায়িত্বশীল হতেই হবে। নয়তো আরো বেশি হারে বিশৃঙ্খলতা ও বিপদের ঘনঘটা অনিবার্য।

লেখক, ফজলুর রহমান: কলামিস্ট এবং উপ-পরিচালক, তথ্য ও প্রকাশনা, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।

Please follow and like us:

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button