মতামত

শবে কদর শ্রেষ্ঠ রজনী

সাইফুল ইসলাম চৌধুরী:: অবারিত রহমতের মাস মাহে রমজানের অংশ মহিমান্বিত লাইলাতুল কদর। ঈমানের বাড়ি মদিনার আঙ্গিনায় সৃজনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক প্রিয়নবী (সাঃ) এ ভূলোকের শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের তালিম দিচ্ছিলেন। কথাপ্রসঙ্গে সেই মজলিসে বনী ইসরাইলের শামউন নামক একজন পুণ্যাত্মা আবেদ-জাহিদের সুদীর্ঘকালের কঠোর সাধনার কথা উঠলো। যে মহান ব্যক্তি দিবসে বিরতিহীন এক হাজার মাস সিয়াম ও আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে রত থাকতেন এবং রজনীব্যাপী জেগে আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত করতেন।

উপস্থিত সম্মানিত সাহাবায়ে কেরাম জগৎগুরু মুহাম্মদ (সাঃ)’র মুখে সন্দেহাতীত সত্য এ ঘটনা তথা আল্লাহর এ নেক বান্দার কঠোর সাধনার কথা শুনে আফসোসের সুরে বলতে লাগলেন, “হায়! আমরাও যদি ঐ সৌভাগ্যবানের মতো দীর্ঘায়ু পেতাম, তাহলে আমরাও ঐ রকম ইবাদত-বন্দেগির মধ্যে দিবস-রজনী অতিবাহিত করতে পারতাম।” ঠিক এসময় খোদার ইবাদত ও নবীর সন্তুষ্টি পাগল সাহাবায়ে কেরামের মনে প্রশান্তির ঢেউ তুলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দেন এক মহা সুসংবাদ! “নিশ্চয়ই আমি কুরআন নাজিল করেছি মর্যাদাপূর্ণ কদর রজনীতে।

(হে হাবিব) আপনি কি জানেন, মহিমাময় কদর রজনী কী? মহিমান্বিত কদর রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতাগণ হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম সমভিব্যাহারে অবতরণ করেন; তাঁদের প্রভু মহান আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে, সব বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তির ধারা চলতে থাকে উষা উদয় পর্যন্ত।” (সূরা আল-কদর) ভালো কাজের স্পর্শ পাওয়ার আকুতি আল্লাহ কতটুকু পছন্দ করেন তা সূরা কদর অবতীর্ণের প্রেক্ষাপটই আমাদের জানিয়ে দেয়।

সাহাবায়ে কেরাম চাইলেন হাজার মাস ইবাদতের সুযোগ। আর দয়াল প্রভু দিলেন একটি মাত্র মহান রাত! যে একটি রাতের ইবাদত হাজার মাস দিবস-রজনী বিরতিহীন ইবাদতের চেয়েও উত্তম। সে রাতের নাম ‘লাইলাতুল কদর’। এমন বরকতময় রাত অন্য কোন সম্মানিত নবীর উম্মতের কপালে জুটেনি। এ রাত শ্রেষ্ঠ নবীর বদান্যতায় পেয়েছি। আল্লাহ সর্বদা চান তাঁর বন্ধুর সন্তুষ্টি। বন্ধু মুহাম্মদ (সাঃ)-কে খুশি করাই আল্লাহর অভিপ্রায়। আর বন্ধু খুশি হন উনার উম্মতদের ভালোবাসলে। তাই রব্বে কায়েনাত বন্ধুর ফলোয়ারদের জন্য এ মহান নিয়ামত (শবে কদর) দান করে নবীর উম্মতদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছেন।

মুসলিম বিশ্বের কাছে এ রাত ‘শবে কদর’ নামেই সমধিক পরিচিত। ‘শবে কদর’ একটি যৌগিক ফারসি শব্দ। যেখানে শব মানে রাত, রজনী আর কদর মানে সম্মান, মর্যাদা, গুণাগুণ, সম্ভাবনা, ভাগ্য। শবে কদর অর্থ হলো মর্যাদার রাত বা ভাগ্যরজনী। শবে কদরের আরবি হলো লাইলাতুল কদর তথা সম্মানিত রাত। ওলামায়ে কেরামের মতে যেহেতু এ রজনী অত্যন্ত মহিমান্বিত ও সম্মানিত তাই এ রজনীকে লাইলাতুল কদর বলা হয়ে থাকে। আবার এ রাত্রে যেহেতু পরবর্তী এক বৎসরের অবধারিত বিধিলিপি ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয় সে কারণেও এ রজনীকে কদরের রজনী বা ভাগ্য রজনী বলা হয়।

কিতাবের ভাষায় শবে কদরে হজরত জিবরাইল (আ.) ফেরেশতাদের বিরাট বহর নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী-পুরুষ নামাজরত অথবা জিকিরে মশগুল থাকে, তাদের জন্য আল্লাহর রহমত কামনা করেন। লাইলাতুল কদরে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিজিক ইত্যাদির পরিমাণ নির্দিষ্ট ফেরেশতাদের লিখে দেওয়া হয়। কিতাবের ভাষ্যমতে সহস্র মাস ইবাদতে যে সওয়াব হয়, কদরের এক রাতের ইবাদত তার চেয়ে অতি উত্তম। লাইলাতুল কদরের অপার মহিমা ও ফজিলতময় রাতে মুমিন মুসলমানদের ওপর আল্লাহর অশেষ রহমত, বরকত ও নিয়ামত বর্ষিত হয়।

এ রাতে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে মাগফিরাত, নাজাত ও ক্ষমা পাওয়ার পরম সুযোগ লাভ করা যায়। নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি এ রাত ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করবে, আল্লাহ তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেবেন।” অন্য বর্ণনায় আছে, “যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে আত্মসমর্পিত হৃদয় নিয়ে ইবাদতে কাটাবে, আল্লাহ তার ইজ্জত ও মর্যাদা বহুগুণ বাড়িয়ে দেবেন।” বুখারী শরীফের হাদিস, হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলে পাক (সাঃ) এরশাদ করেন: “যদি তোমরা কবরকে আলোকময় পেতে চাও তাহলে লাইলাতুল কদরে জাগ্রত থেকে ইবাদত কর।” রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আরও এরশাদ করেন: “যদি কেউ ঈমানের সঙ্গে সাওয়াব লাভের খাঁটি নিয়তে লাইলাতুল কদর কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদে অতিবাহিত করে তবে তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।”

শবে কদরে প্রিয় রাসূল (সাঃ) আম্মাজান আয়েশা (রা.)-কে একটি বিশেষ দোয়া পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। “আল্লাহুমা ইন্নাকা আফুব্বুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী” অর্থাৎ, হে আল্লাহ আপনি বড় ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালোবাসেন। অতএব, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। মুসলিম শরীফের বর্ণনায় পাওয়া যায়, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) রমজান মাসের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন এবং বলতেন, “তোমরা রমজানের শেষ ১০ রাতে শবে কদর সন্ধান করো।” তিনি আরও বলেন, “মাহে রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে তোমরা শবে কদর সন্ধান করো।”

ইমাম আলা হযরত প্রণীত এবং আল্লামা এম এ মান্নান অনুদিত কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান তফসির গ্রন্থে সুরা কদরের ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, এ রাত বছরে একবারই আসে। বহু সংখ্যক বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঐ রাত রমজানুল মুবারকের শেষ তৃতীয়াংশেই হয়ে থাকে। অধিকাংশ ইমামের মতে তাও এ দশ রাতের বেজোড় রাতগুলোর কোন একটা রাতই হয়। বায়হাকী শরীফের বর্ণনা মতে রাসূল পাকে (সাঃ) এ রাতে কিছু আলামতের বর্ণনা দেন। আলামত সমূহের কিছু হলো, ওই রাতটা নির্মল ঝলমলে হবে, নিঝুম নিথর না-অধিক গরম, না-অধিক ঠা-া বরং সবকিছু মাঝামাঝি পর্যায়ে থাকবে। ওই রাতের আকাশ, চাঁদনী রাতের মতো মনে হবে। ওই রাতে সকাল পর্যন্ত শয়তানের প্রতি উল্কা নিক্ষেপ করা হয় না। এটার আরো একটি আলামত হচ্ছে পরদিন সকালে সূর্য কিরণবিহীন একেবারে গোলাকার পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় উদিত হয়। নাজাত পর্বের কোন বেজোড় রাতে শবে কদর তা নিয়ে ওয়ালামে কেরামের মধ্যে ভিন্নমত থাকলেও ইমামে আজম আবু হানিফার মতে রমজানুল মুবারজের ২৭তম রাতেই শবে কদর হয়।

এ দাবীর পক্ষে মুসলিম শরীফের এ হাদিস প্রণিধানযোগ্য, উবাই ইবনে কাব হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি যতদূর জানি রাসূলে পাক (সাঃ) আমাদেরকে যে রজনীকে কদরের রাত হিসেবে কিয়ামুল্লাইল করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা হল রমজানের ২৭তম রজনী। আব্দুল্লাহ বিন উমার থেকে বর্ণিত, রাসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি কদরের রাত অর্জন করতে ইচ্ছুক, সে যেন তা রমজানের ২৭শে রজনীতে অনুসন্ধান করে। যে রাতের ফজিলতে সুরা কদর নাজিল হয়েছে। মাজহাব আমাদের জীবনে কতটুকু প্রাসঙ্গিক তা ইমাম আজমের গবেষণা কর্ম নিয়ে গবেষণা না করলে বুঝা দুষ্কর। আবহমান কাল থেকে সারা বিশ্বে ২৭শে রমজান শবে কদর পালিত হয়ে আসছে সেটা ইমামে আজমের ইজতিহাদের ফল। মারহাবা।

ইবনে মাজাহ শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হজরত রাসূলে পাক (সাঃ) বলেন, “যে লোক শবে কদর থেকে বঞ্চিত হয় সে যেন সমগ্র কল্যাণ থেকে পরিপূর্ণ বঞ্চিত হল।” আবু দাউদ শরিফে উল্লেখ রয়েছে, রাসূলে পাক (সাঃ) এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর পেলো কিন্তু ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে কাটাতে পারলো না, তার মতো হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নেই।” শবে কদরের অবারিত রহমত ও বরকত সকালের তকদিরে নসীব হোক।

এ মহিমান্বিত রজনীর ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হোক সকলের জীবনে। হাজার মাসের শ্রেষ্ঠ রজনীতে আমাদের হাজারো অধরা স্বপ্ন বাস্তব হোক। আমিন।

কলামিস্ট ও ইসলামী বক্তা
খতিব: এ কে এম ফজলুল কবির চৌধুরী জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম।

Please follow and like us:

Related Articles

Back to top button