মতামত

নিরাপদ সড়ক কি স্বপ্নই থাকবে!

মো: জিল্লুর রহমান:: শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার দাবীর সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। এর সূত্রপাত রাজধানীর গুলিস্তানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নাঈম হাসান নামে নটরডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী নিহত হওয়া। ২৪ নভেম্বর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। গুলিস্তান হল মার্কেটের সামনের রাস্তা হেঁটে পার হওয়ার সময় গুলিস্তান জিরো পয়েন্টগামী ময়লা পরিবহনের একটি গাড়ি তাকে ধাক্কা দেয়। এতে গুরুতর আঘাত পায় নাঈম। সঙ্গে সঙ্গে তাকে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এর রেশ কাটতে না কাটতেই মাত্র একদিনের ব্যবধানে রাজধানীতে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় আবারও প্রাণ হারান এক মোটরসাইকেল যাত্রী। রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সের উল্টোদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ময়লার গাড়ির চাপায় প্রাণ হারালেন আহসান কবির খান এবং দৈনিক সংবাদের কম্পিউটার বিভাগে কর্মরত ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য মতে, অন্য সব যানবাহনের সঙ্গে উত্তর সিটির ময়লার গাড়িটি আটকে ছিল। সিগন্যাল ছাড়া মাত্রই সিগন্যালে থাকা একটি মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই মোটরসাইকেলে থাকা আহসান কবীর খান ছিটকে পড়েন। তিনি বাইকের পেছনে ছিলেন। তাঁর মাথার ওপর দিয়ে গাড়ির চাকা চলে যায় এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়েছে। এরপর পেছন থেকে লোকজন ধাওয়া দেয় গাড়িটিকে। গ্রিনরোড সিগন্যাল পর্যন্ত গিয়ে চালক এবং তার সহযোগী গাড়ি সেখানে রেখে পালিয়ে যায়।

নটরডেম কলেজের মেধাবী ছাত্র নাঈম হাসানের মৃত্যুর ঘটনার জের ধরে নগরজুড়ে বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবীতে রাস্তা অবরোধ ও বিক্ষোভ করছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলছে, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে হবে। যেন এভাবে আর কারও প্রাণ সড়কে না ঝরে। কোনো মায়ের কোল যেন খালি না হয়। এভাবে যেন মেধাবী কোনো শিক্ষার্থীর অকাল মৃত্যু না হয়। সড়কে পিষে নাঈমকে হত্যা করা হয়েছে, আগামীকাল আমাকে ও আপনাকে হত্যা করা হবে। সুতরাং, সড়কে শৃঙ্খলা দরকার। এভাবে চলতে পারে না। হত্যাকারীকে দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

অবশ্য এর আগে ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক ও সারা দেশে কার্যকর সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট ২০১৮ পর্যন্ত ব্যাপক আন্দোলন বা গণবিক্ষোভ হয়েছিল। তখন ঢাকায় ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের সংঘর্ষে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হয় ও ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়। এই সড়ক দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে নিহত দুই কলেজ শিক্ষার্থীর সহপাঠিদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে।

আসলে বাংলাদেশে সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থা খুবই বিশৃঙ্খল এবং দুর্ঘটনাপ্রবণ, রাজধানী ঢাকার বাস সার্ভিস গুলোতে যা প্রকটভাবে দৃশ্যমান। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সালের জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৫ হাজার মানুষ নিহত এবং প্রায় ৬২ হাজার আহত হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের করা গবেষণা অনুযায়ী, এসব সড়ক দুর্ঘটনার ৫৩% ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে; ৩৭% চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে এবং বাকি ১০% গাড়ির ত্রুটি ও পরিবেশের কারণে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাবে ২০১৮ সালে দেশে চলমান বৈধ গাড়ির সংখ্যা ছিল ৩৫ লাখ ৪২ হাজার, কিন্তু বৈধ লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা মাত্র ২৬ লাখ ৪০ হাজার। অর্থাৎ প্রায় ৯ লাখ গাড়ি লাইসেন্সবিহীন চালক দ্বারা চালিত হয়। উপরন্তু দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ৪ লাখ ৯৯ হাজার। এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। তখনকার আন্দোলনের পূর্ববর্তী কয়েক মাসে দুই বাসের চাপায় হাত হারানো রাজীব, বাসের হেলপার কর্তৃক নদীতে ফেলে দেয়া পায়েল, বাসচাপায় আহত সৈয়দ মাসুদ রানা, বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই কলেজশিক্ষার্থীর মৃত্যু এবং সর্বশেষ নটরডেম কলেজের মেধাবী ছাত্রের মৃত্যুর  ঘটনায় জনমনে ব্যাপক সমালোচনা ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

আজ থেকে ২৮ বছর আগে ১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনকে হারিয়ে এ আন্দোলন গড়ে তোলেন। ২০১৭ সালের ৫ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২২ অক্টোবরকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেদিন থেকে দিবসটি জাতীয়ভাবে পালিত হয়ে আসছে। এ দিবস পালনের মধ্য দিয়ে প্রতিবছর দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোকে নিরাপদ করার জনদাবি জোরেশোরে উচ্চারিত হয়। তবে প্রশ্ন হলো, এর কোনো সুফল জনগণ পাচ্ছে কি না? আমরা সড়ক কতটুকু নিরাপদ করতে পেরেছি!

দেশে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় ঝরছে প্রাণ, আহত হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন অনেকে। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল কিছুতেই থামছে না। দুর্ঘটনা রোধে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা শুনেছি। কিন্তু তাতে দুর্ঘটনা কমেনি। বেপরোয়া যান চলাচল বন্ধ হয়নি। এতে বোঝা যায়, দুর্ঘটনা রোধের পদক্ষেপগুলোয় অথবা সেসব কার্যকর করার ক্ষেত্রে নানা গলদ রয়ে গেছে। সেসব দূর করা খুবই জরুরি। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেক উঁচু। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শতকরা ৮০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে বিরামহীন গাড়ি চালনা, অত্যধিক গতিতে গাড়ি চালনা এবং চালকের অসাবধানতার কারণে। একজন চালক একটানা চার-পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় গাড়ি চালাবেন, এটাই নিয়ম। কিন্তু দেশের কোনো চালকই এ নিয়ম পালন করেন না। ফলে একজন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত চালক যখন গাড়ি চালান, তখন স্বভাবতই দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে বেশি। এজন্য মূলত বাস মালিকদের অত্যধিক ব্যবসায়িক মনোভাবই দায়ী। এ প্রবণতা রোধে সরকারের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।

২০১৬ সালে সেপ্টেম্বরে বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে একজন বাস চালক বাংলাদেশে বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনার জন্যে চালকদের অতিরিক্ত পরিশ্রমজনিত ঘুমকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছিলেন, দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করার কারণে ড্রাইভাররা খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। সর্বক্ষণ চালকের কাছে থাকা ইঞ্জিনের গরম হাওয়া এবং বাইরের ও আশেপাশের শব্দের কারণেও চালকরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাছাড়া, সারা রাত ডিউটি করার পর আমাদেরকে পরদিন সকালে আবার গাড়ি চালাতে হয়। একটা লোক কিভাবে ২৪ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে পারে? এক সেকেন্ডের জন্যে চোখ বন্ধ হলেও তো অবস্থা খুব খারাপ! মুহূর্তের মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটে যায়। এর জন্য ট্রিপ প্রথা দায়ী। যতদূরের যাত্রাই হোক আসা যাওয়া একজন ড্রাইভারকেই সামলাতে হয়। এরকম অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে ঘুমে ঢলে গিয়ে তিনি নিজেও একবার দুর্ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। তার মতে চালকের ডিউটি যদি সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা বা তারও কম নির্ধারণ করে দেওয়া হয় তাহলে দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেক কমে যাবে।

সড়ক নিরাপত্তা ও নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি। সংগঠনটি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানোসহ ৯টি কারণ চিহ্নিত করেছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- যানবাহনের বেপরোয়া গতি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী বহন, পণ্যবাহী যানবাহন বন্ধের সিদ্ধান্ত অমান্য করা, অদক্ষ চালক ও হেলপার দিয়ে যানবাহন চালানো। সংগঠনটি দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতেও ১২টি সুপারিশও করেছে। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- অতিরিক্ত ভাড়া-নৈরাজ্য বন্ধ করা, চালকের প্রশিক্ষণ, ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করা, ঈদের পরে মনিটরিং কার্যক্রম বহাল রাখা, চালক-শ্রমিকদের বেতন-বোনাস ও কর্মঘণ্টা নিশ্চিত করা, জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে গড়ে তোলা।

জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল দুর্ঘটনা রোধে একটি সময়োপযোগী সড়ক পরিবহণ আইন করার। আইন হয়েছে। কিন্তু এর সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তির নজির নেই। সড়ক পরিবহণ সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এ সংক্রান্ত কমিটি ১১১টি সুপারিশ করেছিল, যেগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন ২০১৮ সালের জুনে। নির্দেশনাগুলো হলো- দূরপাল্লার গাড়িতে বিকল্প চালক রাখা, একজন চালকের পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালানো, চালক ও তার সহকারীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর সড়কের পাশে সার্ভিস সেন্টার বা বিশ্রামাগার তৈরি করা, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা বা সিগন্যাল মেনে পথচারী পারাপারে জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যবহার এবং চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করা। এসব নির্দেশ যাতে বাস্তবায়িত হয়, তা দেখতে তিনজন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রধানমন্ত্রীর যৌক্তিক নির্দেশনা গুলোরও যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। মনে হয় যেন গোয়ালের গরু কেতাবে আছে কিন্তু বাস্তবে নেই।

সড়কের নিরাপত্তা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু। অথচ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে বিষয়টি তেমন গুরুত্বই পাচ্ছে না, যে কারণে দুর্ঘটনা কমছে না। ভুক্তভোগীদের দাবী, প্রধানমন্ত্রীর ছয় দফা নির্দেশনা, সড়ক পরিবহণ সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এ সংক্রান্ত কমিটির ১১১ সুপারিশের দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। সড়ক পরিবহণ আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। সড়কে নিত্যদিন কারও না কারও প্রাণ কেড়ে নিবে, মৃত্যুর মিছিল বাড়তেই থাকবে এবং সময় সময়ে নিরাপদ সড়ক দাবীতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সংগ্রাম চলতেই থাকবে। এর অবসান হওয়া দরকার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কবে সবার জন্য নিশ্চিত হবে নিরাপদ সড়ক। নিরাপদ সড়ক কী অধরাই থেকে যাবে!

লেখক, মো: জিল্লুর রহমান,
ব্যাংকার ও ফ্রিল্যান্স।

Please follow and like us:

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button