কবিতা

নজরুল ব্যাখ্যান । উম্মে হাবিবা চৌধুরী

উম্মে হাবিবা চৌধুরী::

জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গ
অবিভক্ত ব্রিটিশ শাসিত ভারত
জিলা বর্ধমান
মহুকমা শহর আসানসোল
গ্রাম চুরুলিয়া
নাম তাঁর দুখুমিয়া।

দুখুমিয়া কালের পরিক্রমায়
হয়ে উঠেন
সাম্যের কবি মানবতার কবি
নবজাগরণের কবি
বিদ্রোহী কবি
বাংলাদেশের জাতীয় কবি
কাজী নজরুল ইসলাম।

বিংশ শতাব্দীর চলমান সময়ের ঘূর্ণাবর্তে
বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে
হীরক দ্যুতিময়
যুগ প্রবর্তক প্রতিভা তাঁর
শৈল্পিক ছন্দোময়
চমকিত তীক্ষ্ণধার লিখনি তাঁর
বিস্ময়কর এক দুরন্ত ঝটিকাবেগ।

পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে
শাসিত ও শোষিতের
নাগপাশ ছিন্ন করার প্রত্যয়ে,
স্বপ্ন দেখা
মানবতার কবি
নজরুল ছিলেন
বিদ্রোহী প্রেমিক সত্ত্বার
এক সম্মিলিত স্ফূরণ,
সংগ্রামী হৃদয়ের
উষ্ণ শোণিত ধারা।

‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণতূর্য’
মনে হয় যেন
নব ফাল্গুনের দখিন হাওয়া
সজল মেঘের ছায়া
প্রাণোচ্ছলতায় দীপ্তিময়
জ্বলন্ত বিজলী শিখা।
তাঁর বিদ্রোহী কবিতা
কালের খরস্রোতে
কাব্যজগতে
এক মাইল ফলক।

‘আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ’
ভাবের উদ্দীপনা জাগ্রত
ছন্দের দোলায় দোলায়িত
তাঁর আত্মোপলব্ধি আত্মজাগরণ বোধ।
তাঁর মানবিকতা সাম্যবাদ চেতনা
কবিতার ছন্দে ও ভাষায়
উত্তাল তরঙ্গে হয়ে উঠেছিল উদ্ভাসিত
তাইতো বার বার পড়েছিলেন রাজ রোষে।
উপনিবেশিক শাসকের কারাগারে
গেয়েছিলেন শিকল ভাঙার গান
লিখেছিলেন জ্বালাময়ী কবিতা
‘লাথি মার ভাঙরে তালা
যতোসব বন্দীশালা আগুন জ্বালা’
লিখেছেন “রাজবন্দীর জবানবন্দি”
মনে হয় যেন
বাজে ডম্বর গর্জেছে অম্বর
কালো মেঘের ঈশান কোলে
জেগেছে প্রলয় নিশান।
জীবন মরণ পণে
করিব জয় আনিব মুক্তি
দানিব সত্য সুন্দরের হাসি
শতাব্দীর পান্থ পথে।

‘চল চল চল
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’
‘দূর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাপার’
তাঁর কাব্য মনিষা
বাস্তব রূপায়ণে
হয়েছে মূর্ত,
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন
উনষত্তরের গণঅভ্যূত্থান
একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে
বীণার আঁচড়ে
মন্ত্র মননে
উচ্চকিত ও সংহত সুরে
উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল
রুদ্ধদ্বার মুক্তিকামী
আপামর জনতার কন্ঠে,
আগ্নেয়গিরির অগ্নিউৎপাতের
উত্তপ্ত লাভা হয়ে।

‘আল্লাহকে যে পেতে চায়
হযরতকে ভালোবেসে’
তাঁর ভক্তিমূলক গান গজল হামদ নাত
আধ্যাত্মিক নৈসর্গিক অবগাহনে
ভাবের তালে
মত্ত্ব হয়ে
ইন্দ্রিয় সুরে
অতিন্দ্রীয় নেশা,
পার্থিব মায়া মোহে
নিমগ্ন থাকা
অনুভূতিগুলো কিছুক্ষণ
যায় থমকে
জীবন চলার পথে,
অসীম অনন্ত আলোকে
অনুভবে মন ছুঁয়ে যায়
শিহরিত পুলকে।

মনের ঐশ্বর্যগুণে গুণান্বিত
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কবি
মহত্ত্ব যাঁর উদারতা
তাঁর দর্শন তত্ত্ব ছিল
‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই
নহে কিছু মহীয়ান’
অতলস্পর্শী ও চিত্তহারী তাঁর সুরের শতদল।

‘সন্ধ্যা মালতী যবে ফুল বনে ঝরে’
‘এ নহে বিলাস বন্ধু
ফুটেছি জলে কমল’
এ যে বিরহ বিধুর কবি হৃদয়ের নীল যবনিকা
ছন্দ ঝংকার
ও ধ্বনি বৈচিত্র‍্যে
যুগ যুগান্তরের
অশ্রুর অঞ্জলি হয়ে
বেদনাতুরের কান্না।

নারীকে দিয়েছেন সম্মান
লিখেছনে নারী জাগরণী গান
‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’
তিনি নারীকে অধিকারবোধে
করেছেন জাগ্রত,
মর্যাদার আসনে করেছেন অভিষিক্ত।

পেয়েছিলেন তিনি দীর্ঘায়ু জীবন
দুরারোগ্য ব্যাধিতে হয়েছিলেন আক্রান্ত
ভাগ্য বা পরিস্থিতির নির্মম পরিহাসে
বহুবছর ছিলেন তিনি নিষ্ক্রিয়,
সুস্থাবস্থায় স্বল্প পরিসর
তাঁর যাপিত জীবন
তাঁর কর্মচাঞ্চল্যতা উদ্দীপনা।

‘নিশ্চল নিশ্চুপ
আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধ বিধুর ধূপ’
তাঁর বাণী তাঁর জীবনে বাস্তবতার নিঠুর সত্য হয়ে রহিল।

তাঁর লিখা কবিতায়
মনোবাসনা তাঁর
করেছিলেন ব্যক্ত
‘মসজিদের পাশে আমার কবর দিও ভাই’
তাঁর বাসনা হয়েছে পূর্ণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মসজিদের পাশে
আছেন তিনি
অন্তিম শয়নে শায়িত।

মাত্র তেইশ বছর সাহিত্য সাধনা তাঁর
ছন্দে সুরে বহু ভাষার মেলবন্ধনে
করেছেন বাংলা ভাষাকে
স্বাতন্ত্র্যবোধ ও মৌলিকতার আধারে
অনন্য এক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত।

Please follow and like us:

Related Articles

Check Also
Close
Back to top button