শিল্প ও সাহিত্য

বৈশাখী ভাবনা | বিবি হাওয়া স্নেহা

লেখক, বিবি হাওয়া স্নেহা: ‘বড় হুজুরদের বাড়ী বা ওলামা বাড়ী’ নামে দশগ্রামে পরিচিত আমার নানার বাড়ি। নানারা আট ভাই, সবাই বড় আলেম!

আম্মুর শৈশবস্মৃতিতে এসব আছে আমি ভাবতেও পারিনি! কথা প্রসঙ্গে সেদিন জানলাম – আম্মুর দাদীরা পহেলা বৈশাখের এইদিনে ওষুধী খাবার হিসেবে পাঁচন রান্না করতো, বাড়ির আশেপাশের শাক- লতাপাতা কুড়িয়ে এনে। ঘরে ঘরে খই ভেজে এ ঘরে ও ঘরে বিতরণ করতো এবং পুরো জৈষ্ঠ্যমাস আম-কাঁঠাল দিয়ে খই খাওয়া হতো।

ঢালুয়া বাজার অত্র এলাকার বড় বাজার। নানার মুদি দোকান ছিলো সেখানে। পহেলা বৈশাখে তিনি হালখাতার আয়োজন করতেন। দোকানে আগত সবাইকে মিষ্টিমুখ করাতেন। রসগোল্লা, বিরিয়ানী জিলাপি, খাজা-গজা,দই ইত্যাদি বানাতেন নিজের হাতে। আম্মুরাসহ সাহায্য করতেন। হালখাতায় বাকী বাবদ যা পাওনা থাকতেন, তার থেকেও বেশি খরচ করতেন।

নানার মা মুখ চেপে হাসতেন আর বলতেন- “এরে কেপু( নানার নাম কেফায়েতউল্লাহ), তুই যেতুগুন টেঁয়া হাইবি, তিন এতুগুন খরচ কর রি।” নানা উত্তর দিতেন- “থাক মা,আল্লায় বরকত দিবো।”

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো- নানা জিলাপি, রসগোল্লা, দই ইত্যাদি বানানো শিখেছিলেন তার হিন্দু বন্ধুদের কাছ থেকে। বাজারের পাশেই ছিলো হিন্দুদের’সাউ বাড়ি'(আম্মু এই নামটাই বললেন। সম্ভবত ‘সাহা বাড়ি’ হবে)।

সাউ বাড়ি এবং ওলামা বাড়ির মধ্যে বেশ সখ্য ছিলো, একে অপরের বাড়িতে যাতায়াত করতেন!
আমি অবাক হয়ে আম্মুকে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করি- নানা হিন্দুদের কাছ থেকে রান্না শিখেছেন? ওরা নানার ঘরে আসতো? আম্মু জোর গলায় বলেন- হুঁউ, তোর নানা মিলেমিশে থাকতে ভালোবাসতেন। কাউকে খাইয়ে খুব আনন্দ পেতেন! আর হিন্দুরা এসব রান্না ভালো পারতো।

মনে মনে ভাবি- একই কাজ এখন করলে, নানাকে হয়ত ওলামা সমাজ বাড়ি ছাড়া করতো!
আমি নিশ্চিত – খোঁজ নিলেই দেখা যাবে আমাদের আশেপাশে থাকা মুরুব্বিদের অনেকেরই এমন মধুর স্মৃতি আছে। কিন্তু, তারা সমাজের ভয়ে, হতে পারে সন্তানদের ভয়ে- এসব স্মৃতিচারণ করেন না!

কে চালু করছে, কখন থেকে চালু হইছে- এসব মামুলি বিষয়ে ভাবতে চাইনা। আবহমান সংস্কৃতির প্রতিটি উৎসবই কোন না কোনভাবে জীবন-জীবিকার সাথে জড়িত, আবেগ- অনুভূতির সাথে জড়িত। কালের পরিক্রমায় জীবিকার ধরন পরিবর্তন হয়, বদলে যায় উৎসবের রঙ-রূপ-বৈচিত্র‍্য। কিন্তু, মিলেমিশে আনন্দ করার উপলক্ষ্যে যেনো কখনো বিভাজন না হয়…

ইদানীং কপি পেস্ট ফতোয়া খুব চলছে! কোথাও কিছু একটা পেলেই তলিয়ে দেখার বালাই নেই। শেয়ার মিছিলে সামিল হয়ে যাই। এতে করে কি হচ্ছে- দিন দিন একা হয়ে যাচ্ছে সবাই! ভাতৃত্ব, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা’র স্থান দখল করছে- হিংসা, ঘৃণা, অহমিকাবোধ।

আমরা সবাই প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতিতেই মিশে যাবো। যাবার আগে কয়টা দিন একসঙ্গে বাঁচি…

শুভ হোক বাংলা নববর্ষ। এসো হে বঙ্গাব্দ ১৪৩১।

বিবি হাওয়া স্নেহাঃ শিক্ষক, লেখক ও সংগঠক।

Please follow and like us:

Related Articles

Back to top button