মতামত

শিক্ষকের ঋণ

ডঃশিপক নাথ:: যে মানুষটার শিক্ষায় আজ আমি নিজেকে মানুষ বলে দাবি করি তিনি হচ্ছেন আমার শিক্ষক। মা-বাবার পরে যে মানুষটা আমাদের হাতে ধরে পৃথিবী চিনিয়ে দেন সে মানুষটাকে একটা সময় এক প্রকারে আমরা ভুলেই যায়। পুরো শিক্ষাজীবনে হাজারো অভিযোগ থাকে আমাদের শিক্ষকদের উপরে। অথচ শিক্ষাজীবনে একটি বার তখন ভাবিনি যে এই মানুষগুলোর জন্যে আমরা মানুষ হতে পারব। যে শিক্ষকের কড়া শাসনে আমরা সবসময় বিরক্ত হয়ে থাকতাম সে শিক্ষকদের কথা মনে পরলে আজ আমার চোখের কোণে জল গড়ায়। শিক্ষকদের ভয়ে ভয়ে শ্রদ্ধা ও সম্মান করতাম শিক্ষাজীবনে। অথচ তারাই ছিলেন আমার বাবার মতো দায়িত্বশীল একজন মানুষ। যে মানুষেরা আমাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দিতেন, ভালো-মন্দ বিচার করার জন্য আমাদের মস্তিষ্কে বুদ্ধি ও হৃদয়ে বিবিধ তৈরি করিয়ে দিতেন অতি সুদ্ক্ষ হাতে। মন থেকে ভালোবাসার আগেই আমরা অনেক সময় হারিয়ে ফেলি সেই শিক্ষকদের। যাদের জন্য আজ আমরা মানুষ নামধারী। একটা সময় প্রতিটা মানুষ শৈশবে ফিরে যেতে চাই। ঠিক তেমনি আমিও ফিরে যেতে চাই। খুব মনে হয় যদি আরেকটাবার ফিরে যেতে পারতাম সেই বিদ্যালয়ে। যেখানে সাদা শার্ট আর পেন্ট পড়ে দাড়িয়ে থাকতেন আমার শিক্ষকেরা। যেখানে মায়ের মতো শাড়ির আঁচলের মায়ায় জড়িয়ে রাখতেন শিক্ষিকারা।

অল্প বেতনে ছোট্ট কোয়াটারের ঘরগুলোতে থাকতেন আমার শিক্ষকেরা। দ্রব্য মূল্যের চড়া বাজারে সংসারে নানা টানা পোড়নকে হার মানিয়ে আমাদের শিক্ষকেরা এই সমাজে মাথা উঁচু করে চলেন। তাদের মুখে অকৃত্রিম হাসি ফুটে উঠত যখন আমরা পরীক্ষায় উচ্চ নাম্বার পেতাম। সেই আনন্দময় জ্বলজ্বল করা চোখগুলো আজকাল আমাকে ভীষণ তাড়িয়ে বেড়ায়। বুকের ভেতর একটা হাহাকার যেন দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। সেই হাহাকারের নাম হচ্ছে শিক্ষকদের সঠিক মূল্যায়ন করতে না পারা। এই অনিয়মের সমাজে আজকাল শিক্ষকেরা বেত নিয়ে শ্রেণীকক্ষে যেতে পারেন না। উচ্চস্বরে এখন তারা কথাও বলতে পারেন না। কারণ শিক্ষার্থীদের একটা অংশ এখন অপরাধের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে খুব দ্রুত।

সমাজে অপসংস্কৃতি দারুণ ভাবে মিশে যাচ্ছে। যার প্রভাবে অসংখ্য শিক্ষার্থী শিক্ষকদের সাথে অপরাধ করতে দ্বিধাবোধ করে না। অথচ আমরা শিক্ষকদের ঐ বেতের ভয়ে নয়তো ধমকের ভয়ে একদিন মানুষ হবার অদম্য লড়াই করেছি। মাঝে মাঝে ভাবলে ভীষণ অবাক লাগে আমরা খুব অল্পতেই কত বিরক্ত হয়ে যায়। অথচ একটা পড়া না বুঝলে শিক্ষকের কাছে কত শতবার জিজ্ঞাসা করতাম। তারাও আমাদের যত্ন সহকারে অসংখ্য বার বুঝিয়ে দিতেন। কিন্তু কখনো বিরক্ত হতেন না। ধৈর্যের মশাল হাতে দৃঢ়চিত্তে সেই শিক্ষকেরাই আমাদের সঠিক মানুষ করে গড়ে তোলার কাজ করেছেন। এই আমরাই পান থেকে চুন খসলেই তাদের হেয় প্রতিপন্ন করার কোন সুযোগ হাতছাড়া করতাম না। আজকাল ভীষণ যন্ত্রণা হয়। বিবেকের কাঠ গড়াই দাড়িয়ে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়। শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান না জানিয়ে উল্টো তাদের নিয়ে রসিকতা করাই ছিল আমাদের প্রধান কাজ।

আজ চাইলেও আর ফিরে পাব না সেই সোনালী দিনগুলো। যেখানে আমার শিক্ষকেরা ছিলেন আমাদের আদর্শের গুরু। তবুও আমি বার বার ফিরে যেতে চাই সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে। যেখানে আমি চিরঋণী হয়ে আছি সকল শিক্ষকের কাছে। জয়তু আমার শিক্ষক ও শিক্ষিকারা যাদের জন্য আজ আমি এই সমাজে প্রতিষ্ঠিত..

ড. শিপক নাথ
সভাপতি, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Please follow and like us:

Related Articles

Leave a Reply

Back to top button